ওষুধের দাম বাড়ছে, নিয়ন্ত্রণ জরুরি

Published: 04 May 2024

প্রতিদিন হু হু করে বাড়ছে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম। গত ২ সপ্তাহে ৭ থেকে ১৪০ শতাংশ ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে মর্মে গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদের প্রতিবেদন সংযুক্ত করে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) গত ২৯ এপ্রিল হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সব ধরনের ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি রোধকল্পে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ প্রদান ও রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট। বর্তমানে দেশে ৩১০টি অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

সার্বিকভাবে ওষুধের দাম ও মান নিয়ন্ত্রণে কয়েকটি সুপারিশ : ক. ১১৭টির পরিবর্তে ১/৩ ভাগ ওষুধের তালিকা প্রণয়ন; খ. ১০০০ ট্যাবলেট/ক্যাপসুল কনটেইনারে সরবরাহ; গ. গজ-এর পরিবর্তে ডিজিটাল মার্কেটিং চালু করা; ঘ. ট্রেড নামের বদলে জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন; ঙ. মূল্য নির্ধারণে স্বাধীন কমিশন গঠন।

ওষুধের দাম বাড়ার পেছনে ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সাম্প্রতিককালে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসসহ বিভিন্ন ইউটিলিটিজের মূল্যবৃদ্ধি, বিশ্ববাজারে ওষুধের কাঁচামাল বৃদ্ধি, মার্কেটিং খরচ বেড়ে যাওয়াসহ ডলারের বিনিময় মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করছেন। ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন Bangladesh Association of Pharmaceutical Industries (BAPI) বিভিন্ন ফোরামে ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করে আসছে। দেশে ওষুধের বাজার প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার কোটি টাকার। ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো ৪১৮০টি জেনেরিকের ৩৫,২৯০টি ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন করে থাকে। এর মধ্যে প্রাইমারি হেলথ কেয়ারের ১১৭টি জেনেরিকের ওষুধের মূল্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বাকি সব ওষুধের মূল্য প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো নির্ধারণ করে ভ্যাট প্রদানের নিমিত্তে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করে থাকে।

১৯৮২ সালে প্রণীত ঔষধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশের ১১ ধারার বিধান মতে, সব ওষুধের মূল্য সরকারের নিয়ন্ত্রণ করার কথা ছিল। কিন্তু সদ্য প্রণীত ঔষধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩-এর ৩০(১) (২) ধারার বিধান মোতাবেক শুধু গেজেটে প্রকাশিত তালিকাভুক্ত ওষুধগুলোর খুচরা মূল্য সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। ফলে ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো ইচ্ছামতো ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ নিচ্ছে বলে ভোক্তারা অভিযোগ করে আসছেন। এ পরিস্থিতিতে বিজ্ঞমহল মনে করেন, ১৯৯৪ সালে জারিকৃত গেজেট সংশোধন করে ১১৭টি জেনেরিকের পরিবর্তে মোট ওষুধের এক-তৃতীয়াংশ অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা প্রণয়ন করা দরকার। তারা আরও মনে করেন, এই তালিকার মাধ্যমে সরকার ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।

অধিকাংশ ওষুধ উৎপাদনের কাঁচামাল (Raw Materials) বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এছাড়া লেবেল, কার্টন, মোড়ক সামগ্রী, পরিবহন, সংরক্ষণ এবং মার্কেটিং খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়ে থাকে। কোম্পানিগুলো গেটআপ আকর্ষণীয় করতে চকচকে মোড়কে ওষুধ বাজারজাত করে থাকে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তৎকালীন সিনিয়র সচিব ড. মো. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এক সভায় মোড়ক সামগ্রীর চাকচিক্য পরিহার করে ওষুধের মূল্য কমানোর দাবি করে প্রশ্ন করেছিলেন ‘মানুষ প্যাকেট খাবে নাকি ওষুধ খাবে?’ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ১০০ ওষুধের বক্সের পরিবর্তে ১০০০ ট্যাবলেট/ক্যাপসুলের টিন বা প্লাস্টিক কন্টেইনারে সরবরাহ করা হলেও প্যাকেজিং খাতে খরচ অনেক কমে যাবে।

প্রায় সব ওষুধ কোম্পানি Medical Representative (MR)-এর মাধ্যমে মার্কেটিং করে থাকে। শুধু জেলা বা উপজেলা নয়, এমনকি গ্রামের বড় বড় বাজারে পর্যন্ত কোম্পানিগুলোর মার্কেটিং নেটওয়ার্ক MR-এর মাধ্যমে বিস্তৃত রয়েছে। যার সংখ্যা কয়েক লাখ হতে পারে। এসব জনবলের বেতন-ভাতা, মোটরসাইকেলের জ্বালানি, উৎপাদিত ওষুধের মূল্যের সঙ্গে মার্কেটিং খরচ হিসেবে সমন্বয় করা হয়ে থাকে।

বর্তমান সরকারের Smart Bangladesh  গড়ার প্রত্যয়ে অফিসগুলো ইতিমধ্যে পেপারলেস করা শুরু হয়েছে। এখন বিয়ের দাওয়াত কার্ডও ই-মেইল,  হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়। তাই ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদিত ওষুধের প্রচার-প্রচারণা সহজেই করতে পারে। ফলে মার্কেটিং খরচের বিরাট অঙ্কের অর্থ সাশ্রয় হতে পারে, যা ওষুধের মূল্য বহুলাংশে কমাতে সহায়ক হবে।

দীর্ঘদিনের পুরনো অভিযোগ রয়েছে যে, ওষুধ  কোম্পানিগুলো ডাক্তারদের ফ্ল্যাট, গাড়ি, বিদেশ ভ্রমণসহ নানান ধরনের উপহার সামগ্রী প্রদান করে যেন চিকিৎসকরা তাদের কোম্পানির ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন। যার ব্যয়ভার ভোক্তাকে পরিশোধ করতে হয় উচ্চমূল্যে ওষুধ ক্রয়ের মাধ্যমে। উন্নত বিশ্বের মতো ট্রেডনামের পরিবর্তে Generic নাম সব কোম্পানির ওষুধের একই নাম হবে, যেমন Paracetamol) প্রেসক্রিপশন করার বিধান করা যেতে পারে। ফলে কোম্পানিগুলোর মধ্যে ওষুধ মার্কেটিংয়ের অসুস্থ প্রতিযোগিতা (Unethical Practice) বন্ধ হবে এবং ওষুধের দামও অনেকাংশে কমে যাবে।

সর্বোপরি ওষুধের মূল্য নির্ধারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের আদলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, BMA, BAPI, CAB-সহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন শক্তিশালী কমিশন গঠন দরকার। এই কমশিন সময়ে সময়ে ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে দেবে। ফলে ওষুধ কোম্পানিগুলোর ইচ্ছামতো মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা কমে যাবে। আশা করি এসব পদক্ষেপে দেশের জনগণের ন্যায্যমূল্যে মানসম্মত ওষুধ প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে এবং ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরসহ এই সেক্টরের সুনাম বৃদ্ধি পাবে।

ড. এম. এন. আলম, সাবেক উপপরিচালক ও আইন কর্মকর্তা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।
দেশ রূপান্তর, ০৪ মে ২০২৪